দৈনিক তালাশ.কমঃপার্বত্য জেলা বান্দরবানভিত্তিক নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির বোমা বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিতে সেনাবাহিনীর দুই সৈনিক নিহত হয়েছেন,আহত হয়েছেন আরও দুই কর্মকর্তা।
বুধবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে। তবে নিহত ও আহতদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,বান্দরবানের রুমা উপজেলার জারুলছড়ি এলাকায় মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রথম আক্রমণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর কেএনএ-এর এটি দ্বিতীয় হামলা ও প্রাণহানির ঘটনা।
মার্চের হামলায় সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন।আহত হয়েছিলেন আরও দুই সেনা সদস্য।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা,কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার কিছু অংশ, মিয়ানমারের চিন রাজ্য ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অন্তত দু’টি রাজ্য,মনিপুর ও মিজোরাম অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন,এসব অঞ্চলে কুকি জনগোষ্ঠী রয়েছে।
যা বলছে আইএসপিআর
বিজ্ঞপ্তি অনুসারে,গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বান্দরবানের রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন জারুলছড়িপাড়ায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পাওয়া যায়।
সংবাদের ভিত্তিতে সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের মেজর মনোয়ারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টহল দল দ্রুততার সঙ্গে জারুলছড়িপাড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে।এতে দুজন কর্মকর্তা ও দুজন সৈনিক আহত হন বলে জানায় আইএসপিআর।
আহতদের দ্রুত হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেবার পর চিকিৎসারত অবস্থায় আহত দুই সৈনিক মারা যান।
আহত দুই কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
“সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএ বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহিন অরণ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে,” বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আইএসপিআর।
দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ সেনা সদস্যদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে সেনাপ্রধান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
‘কুকি চিনের কোনো বড়ো টার্গেট রয়েছে’
“আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর এমন হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফারুক খান।
তিনি বলেন, “সরকারের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে তাঁরা যেন কঠোর হাতে এ ধরনের সন্ত্রাসীদের দমন করেন।”
“পার্বত্য চট্টগ্রাম সব সময়ই সন্ত্রাসীদের আখড়া ছিল। আমরা ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেখানে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলাম। তবে মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনরায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেখান থেকে সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এবং এ রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঘটাচ্ছে,” বলেন ফারুক খান।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে “বিদেশি মদদ” রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন ফারুক খান। তবে কোন দেশ কেএনএ-কে মদদ দিচ্ছে সে ব্যাপারে কিছু জানাননি তিনি।
গত বছরের মে মাসে ফেসবুকে বার্তা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এই সংগঠনের সামরিক শাখা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
ফেসবুকে পেজ খুলে দাবি করা হয়, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। সেগুলো হলো; বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি।
কেএনএফ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি করছে।
সংগঠনটির বিরুদ্ধে গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে অভিযান পরিচালনা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বলছে, সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
ইতোমধ্যে জঙ্গি গোষ্ঠীর অনেক সদস্যকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের ভাষ্য, কেএনএ-এর কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে নতুন জঙ্গি সংগঠনটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক বিবৃতিতে জানানো হয়, কেএনএফ প্রধান রুমা উপজেলা সদর বাজারের বাসিন্দা নাথান বম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ছিলেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, “সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর পুনরায় হামলার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, কুকি চিনের কোনো বড়ো টার্গেট রয়েছে যা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন“সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে সংখ্যাগুরু মেইতেই জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে সেখানকার কুকি গোষ্ঠীর জাতিগত সংঘর্ষ হয়েছে। এই ঘটনাকে বাংলাদেশের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। মিয়ানমারের চিন রাজ্যেও বম জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে।”
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের ধারণা,কেএনএ-কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী চিন ন্যাশনাল আর্মি। অস্ত্র আসছে মিয়ানমারের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের কাছ থেকে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন,১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির আওতায় বান্দরবান থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪২টি সামরিক ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে।সেনাবাহিনী বর্তমানে কেবলমাত্র টহল কাজ পরিচালনা করে।”