দৈনিক তালাশ.কমঃকক্সবাজারের উখিয়ার ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা শিবিরের একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দায়িত্ব পালন করছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এর সদস্যরা। ১২ জুলাই ২০২৩।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) অভিযোগ করেছে,কক্সবাজারে শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যদাতা (সোর্স) হিসেবে ব্যবহার করে তাঁদের অপরাধী চক্রের সহিংসতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং অপরাধী চক্রের সহিংসতা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার বিবৃতি দেয় এইচআরডব্লিউ।
এতে বলা হয়“কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করছে। ফলে তাঁরা অপহরণ বা হত্যার মতো গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ছেন। কোনো প্রকার সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই এই কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার তাঁদের জীবন বিপন্ন করছে।সরকারের উচিত শরণার্থী ও জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি সম্মানজনক নিরাপত্তা নীতি তৈরি করা। দাতাদের উচিত ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়া। কারণ তারা আইনি সুরক্ষাবঞ্চিত,বলা হয় বিবৃতিতে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নেওয়া ৪৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার এবং পুলিশ ও মেডিকেল রিপোর্টসহ অন্যান্য নথি বিশ্লেষণ করেছে মানবাধিকার সংগঠনটি। এইচআরডব্লিউ বলছে, ভুক্তভোগীরা পুলিশ,আইনি ও চিকিৎসা সহায়তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
গত এক বছরে বেশ কিছু মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) হামলার শিকার ও খুন হয়েছেন। যারা মূলত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করায় আরসা সদস্যদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন,বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, রাতে পাহারা, অভিযান ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের শনাক্ত করতে পুলিশ তাঁদের বাধ্য করত।
নিহত মাঝিদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা আগে ক্যাম্প ইনচার্জ এবং এপিবিএনের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, কেউ কেউ হুমকিদাতাদের তালিকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সাহায্য পাননি,” বলা হয় বিবৃতিতে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতীত প্রতিশ্রুতি এখন সহিংস গোষ্ঠী এবং একটি উদাসীন বিচার ব্যবস্থার ফলে হুমকির মুখে,” বিবৃতিতে বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।
তিনি বলেন,রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের ক্রমবর্ধমান স্পষ্ট অভিপ্রায় সরকারকে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ২০২২ সালে শিবিরে ৪০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হত্যা করেছে এবং ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এই সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৪৮ জন।
মানবাধিকার সংস্থাটির দাবি, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
এতে বলা হয়,গত ৬ ও ৭ জুলাই তিনটি ঘটনায় সাতজন শরণার্থী নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। যার মধ্যে একজন সাব-মাঝি (ক্যাম্প সম্প্রদায়ের নেতা) এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর কথিত সদস্য রয়েছেন।
শরণার্থীদের জন্য কোনো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা নেই’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়, শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহিংসতায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই রোহিঙ্গা নেতা বা তাঁদের পরিবারের সদস্য।
অনেক শরণার্থীকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে এবং হুমকি দেওয়া বা নির্যাতন করা হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীতে শিশু নিয়োগের মতো ঘটনা ঘটছে বলেও জানা গেছে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার ব্যক্তিরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), মুন্না গ্যাং, ইসলামি মাহাজ এবং আরও কয়েকটি গ্রুপের সদস্যদের দায়ী করেছে।
এতে বলা হয়, শরণার্থীদের জন্য কোনো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা নেই বলে তারা থানায় অভিযোগ জানাতে পারে না।
বেশ কয়েকটি পরিবার বলেছে, তারা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার জন্য ক্যাম্প-ইনচার্জের (সিআইসি, বাংলাদেশের কর্মকর্তা) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি পায়নি, বলা হয় বিবৃতিতে।
“বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের জন্য রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই শরণার্থী বসতিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান। তবে যেহেতু রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি বর্তমানে বিদ্যমান নেই,তাই সরকারের উচিত শরণার্থী এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি সম্মানজনক একটি শিবির-নিরাপত্তা নীতি তৈরি করা,বলা হয় বিবৃতিতে।রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় বাহিনীগুলো খুবই আন্তরিক: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের বাহিনীগুলো খুবই আন্তরিক। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো বাহিনীর সদস্যরাও বিপদে পড়ছে।”
শিবিরগুলোতে প্রচুর সংখ্যক সন্ত্রাসী অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরে যেভাবে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তা মোকাবেলা করা খুব সহজ নয়। এই কাজ করতে গিয়ে আমাদেরকে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।”
শরণার্থীরা আইনি অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন এমন অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।
রোহিঙ্গাদের বলপূর্বক তথ্যদাতা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এমন অভিযোগ সম্পর্কে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের জোর করা হচ্ছে বিষয়টি অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন।”
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার বিষয়টিতে “অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে” জানিয়ে তিনি বলেন, “ক্যাম্পে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া জেলা পুলিশ ও র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এখানে কাজ করছে।”
অনেক সময় রোহিঙ্গা নেতারা তাদের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে বলে জানান ফারুক আহমেদ।
তিনি বলেন “ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় ক্যাম্পগুলোতে আমাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তবুও আমরা জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।”সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয়-ভীতির মধ্যে’বর্তমানে শিবিরগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র দল প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়, যার ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন বলে বেনারকে জানান আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জুবায়ের।
তিনি বলেন, ক্যাম্প ঘনবসতি হওয়ায় সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করতে এপিবিএন কিছু রোহিঙ্গাদের সহযোগী ‘সোর্স’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী গ্রুপদের মধ্য সংঘর্ষ লেগে থাকার কারণে শরণার্থী শিবিরগুলোতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয়-ভীতির মধ্যে রয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা মো. সৈয়দ হোসেন।
এর ফলে “অনেক সময় সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি অনেক নিরীহ মানুষও”হতাহতের শিকার হয় বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্য অনুসারে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা,স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। এর মধ্য চলতি বছরের সাত মাসে (১২ জুলাই পর্যন্ত) শরণার্থী শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন। শুধু চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনেই ১১টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।