ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে গত কয়েক বছরের সব রেকর্ড। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড়। গতকাল একদিনে রেকর্ড ৮২০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পাশাপাশি ক্রমেই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারও ছাড়িয়ে গেছে অন্য সব বছরের রেকর্ড।চলতি বছরে ইতোমধ্যে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।বিশেষ করে রাজধানীতে এর ভয়াবহতা পৌঁছেছে চরম মাত্রায়।তাই দায়িত্বরতদের মশক নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। গত ২৪ ঘন্টায় (গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮২০ জন (একদিনে সর্বোচ্চ) রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬০৩ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১৭ জন। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২৫০২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১৭৭৩ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭২৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ১১৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।এর মধ্যে ঢাকায় ৮ হাজার ৫৭৪ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ হাজার ৫৪৯ জন।ঢাকায় ৬ হাজার ৭৫০ এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৭৯৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।এদিকে দেশের প্রায় ৫৩টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসটি। সব বয়সী মানুষের জন্য আতঙ্কের হলেও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক করে ফেলছে ডেঙ্গু।ফলে চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী,দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।তাই ডেঙ্গু নিয়ে সামনে আরেকটা বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র প্রফেসর ডা. মো. নাজমুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন,অনেকে জানেন না কখন রোগ পরীক্ষা করাতে হবে।পরীক্ষা না করে তারা বসে থাকেন।অনেকে জ্বর হলে পাত্তা দেন না বা আমলে নেন না।অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসক বা পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এসব কারণে রোগ ভালো হয় না,তারা শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসেন।এটাই বেশি মৃত্যুর কারণ।ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন,ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবার অনেক আগেই শুরু হয়েছে।ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বছরের এই সময়ের তুলনায় কয়েকগুন ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ২০১৯ সালের দেশে যে ভয়াবহ ডেঙ্গুর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল (রোগী ১ লাখ ছাড়িয়ে ছিল)। আশঙ্কা করা হচ্ছে সে রেকর্ড ভাঙবে এ বছর।
সরেজমিন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে দেখা যায়,শিশুদের জন্য দেশের সবচেয়ে বড় এ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী।যাদের অনেকেই আসছেন ঢাকার বাইরে থেকে।নানা জটিলতা দেখা দেয়ায় তাদের ঢাকায় আনতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে জ্বর, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানা,বমিসহ নানা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। ঈদের ছুটির পর পুরোদমে স্কুল খুললে শিশু ডেঙ্গু রোগী বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এ জন্য জ্বরের তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
রাজধানীর মহাখালীর আজতপাড়া এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান ময়নার একমাত্র সন্তান তাহসিন। ঈদের আগের দিন ২৮ জুন থেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। এরপর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত তাহসিন, রক্তে প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে তার। চিকিৎসার এক পর্যায়ে তাকে আইসিইউতেও রাখা হয়। তবে সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়ে চিরবিদায় নেয় ৮ বছরের এই শিশু। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে জীবনের এমন পরিণতি ডেঙ্গুর থাবায়। মাস সাতেক আগে এখানেই ডেঙ্গুতে প্রাণ গেছে তাহসিনের ১০ বছর বয়সী খালাতো বোনের।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইলমা জাহানও পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন ডেঙ্গুর প্রকোপে। ঢাকার মালিবাগে বাস করা ইকবাল কবির ও মাকসুদা আক্তার জাহান দম্পতি তাদের একমাত্র সন্তান হারিয়ে এখন নিঃস্ব। প্রাণোচ্ছল ইলমাকে হারানোর ব্যাথা কি করে বইবেন তারা?
নিহত ইলমার বাবা-মার আহাজারি, একমাত্র আদরের সন্তানকে হারিয়ে এখন তাদের চোখে শুধুই শূন্যতা। বাকিটা জীবন কীভাবে কাটাবেন সে কথা ভেবেই শোকে বিহ্বল তারা।
রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত ৭ মাসে ৬৭ জনের মৃত্যুর মধ্যে চট্টগ্রামের শ্রাবন্তি সরকার। মেয়ের শেষকৃত্য শেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় তার পরিবার। ডেঙ্গুতে নিহত শ্রাবন্তী সরকারের বাবা বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর কিছুই খাচ্ছিলো না শ্রাবন্তি। কিন্তু হঠাৎ তার পেট ফুলে যায়। এর কিছুদিন পরই সব শেষ। এখন ছেলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত। সব মিলিয়ে দিশেহারা পরিবারটি।
সামান্য কীট থেকে ছড়াচ্ছে যে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু, সেই মশা নিধনে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে প্রশাসনের তরফে। বলা হচ্ছে, সচেতন হতে হবে বাসিন্দাদেরও। কিন্তু যারা এরই মধ্যে স্বজন হারিয়েছেন, তাদের ক্ষোভের অন্ত নেই। তারা মনে করছেন সরকার ও নগরপ্রশানের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্তের লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে জ্বরের কথা বলেছেন। যা ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। জ্বর হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বরে আক্রান্ত হওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা ও চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছে, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছে। একই সঙ্গে জ্বর হলে বিশ্রামের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে রাজশাহী ব্যুরো জানান, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত পাপ্পু (৪০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সে রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাসিন্দা। গতকাল সকালে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএফ শামীম আহাম্মদ জানান, মৃত পাপ্পু গত ২ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হয়। সে মুন্সিগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। তার এক কানে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলমান ছিলো। তিনি আক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে হাসপাতালে ভর্তি হন।
এদিকে হাসপাতালের তথ্যমতে গতকাল বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭ জন রোগী ভর্তি আছেন। এ পর্যন্ত ৩৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি গেছেন ২৭ জন। তিনি জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে।