দৈনিক তালাশ.কমঃমো:জাহিদ হাসান বিশেষ প্রতিনিধি: দ্রুত এসে স্থলভাগে অনেকক্ষণ রইল ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। মিধিলিকে ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ দুপুর ১২টায় এর অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপকূল স্পর্শ করে। বরিশাল-খুলনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলজুড়ে শুরু হয় ঝোড়ো বাতাস। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র বেলা তিনটায় উপকূল অতিক্রম করার সময় বাতাসের গতি ও বৃষ্টি বেড়ে যায়।
কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র সাগর থেকে ভূখণ্ডে উঠে গেলে তা স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি গতকাল শুক্রবার রাত নয়টা পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে স্থল নিম্নচাপ অবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অর্থাৎ প্রায় আট ঘণ্টা ধরে এর প্রভাবে সারা দেশে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ওই অর্থে বেশ ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ১৪ বছর আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র মিল খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র কারণে নদী পথে বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এই বৈরি আবহাওয়ার মধ্যে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে কীর্তনখোলা নদী পারাপার করছে। ষ্টীমার ঘাট,আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত তা একই অবস্থায় থেকে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে। এই হিসাবে প্রায় এক দিন বা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ঘূর্ণিঝড় ও স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি ঝরেছে। এর আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলো দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের ভূখণ্ড অতিক্রম করে গেছে। সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা এর প্রভাবে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি ঝরেছে। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ওই অর্থে বেশ ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ১৪ বছর আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র মিল খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের গভীরতা কম। ফলে এখানে ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি আসার পর তা দ্রুত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে উঠে পড়ে। কিন্তু আগের ঝড়গুলোর তুলনায় মিধিলির পার্থক্য হচ্ছে এটি সৃষ্টি হয়েছে উপকূলের খুব কাছে, প্রায় ৪৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। অন্য ঝড়গুলো ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে আন্দামান সাগরের দিকে সৃষ্টি হয়ে দুই থেকে চার দিন ধরে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দিকে আসে। এই ঝড় সৃষ্টি হওয়ার পর ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে উপকূলের দিকে এগিয়েছে।বিশেষ করে বাতাসের গতি ও বৃষ্টিপাতের ধরনের সঙ্গে আইলার মিল খুঁজে পেয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাত করার সময় উপকূলীয় এলাকায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৯০ কিলোমিটার। মিধিলি আঘাত করার সময়েও বাতাসের গতি প্রায় একই ছিল। সর্বোচ্চ গতি উঠেছিল সাড়ে তিনটার দিকে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ১০২ কিলোমিটার। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সর্বোচ্চ বৃষ্টি ঝরেছে ভোলায় ২৪৯ মিলিমিটার। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৬০ থেকে ২৩২ মিলিমিটার.বৃষ্টি হয়েছে। আইলার মতোই ওই বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া ঝড় আঘাত হানার ১০ ঘণ্টা পরও চলেছে।
তবে গতকালের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আইলার অমিল ছিল জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতার ক্ষেত্রে। আইলার সময় ছিল ভরা পূর্ণিমা। ফলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল বেশি। যে কারণে ওই ঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। উঁচু জলোচ্ছ্বাস কোথাও কোথাও বাঁধ টপকে দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করে। ফলে খুব বেশি প্রাণহানি না ঘটলেও সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল বেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানে, সাধারণত দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা স্থল নিম্নচাপ থেকে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অতিক্রম করে যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আঘাত হানার পর যে স্থল নিম্নচাপটি তৈরি হয়েছে, তা গতকাল রাত পর্যন্ত দেশের বরিশাল উপকূলে বেশি সক্রিয় ছিল। আজ দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তা অবস্থান করে দুর্বল হতে পারে। সেই অর্থে তা ঘূর্ণিঝড় আইলার মতো প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে বৃষ্টি ঝরিয়েছে।আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে মোট ৬২টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে মোট ১২টি ঝড় সরাসরি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। যার বেশির ভাগ আঘাত করেছে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি যে পথ দিয়ে এসেছে সে পথে, অর্থাৎ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, খুলনা ও বরিশাল উপকূলে। সুন্দরবনের কারণে বেশ কয়েকটি ঝড় তার বাতাসের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়েছে। ফলে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি কমেছে।আবহাওয়াবিদদের মতে, ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আগে এ বছর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ ও অক্টোবরে ‘হামুন’ বাংলাদেশে আঘাত হানে। গত বছর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। গত দুই বছরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মিধিলির অস্বাভাবিক আচরণ একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মিধিলিসহ এ বছর তিনটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করার মূল কারণ বঙ্গোপসাগরের অতিরিক্ত উষ্ণতা। এ সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ২৬ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু দুই মাস ধরে সেখানে তাপমাত্রা ২৯ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। যে কারণে সেখানে গত এক মাসের মধ্যে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল। ফলে এত দিন আমরা মনে করতাম সাধারণত প্রতি এক–দুই বছরে একটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে। গত কয়েক বছরে তা ভুল প্রমাণিত হলো। ফলে বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড় হতে পারে, এই আশঙ্কা মাথায় রেখে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা নিতে হবে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশ অঞ্চলের চারপাশ ঘিরে মোট চারটি উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় রয়েছে। একটি বিহার-উত্তর প্রদেশ এলাকায়, দ্বিতীয়টি মধ্য বঙ্গোপসাগরে, তৃতীয়টি লাওস-কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম উপকূলে, চতুর্থটি মেঘালয়-তিব্বত এলাকায়। সাধারণত এ সময়ে একটি উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় থাকে। ফলে এর চাপে স্থল নিম্নচাপটি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় দ্রুত সরে যায়। কিন্তু একসঙ্গে চারটি উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় থাকায় স্থল নিম্নচাপটি একই এলাকায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যে কারণে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম উপকূলজুড়ে প্রবল বৃষ্টি ঝরছে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে পরিবর্তন আসছে। এসব বদল আমাদের এ অঞ্চলে দুর্যোগের সংখ্যা ও ধরনে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এই ঝড় থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পেলাম।’