দৈনিক তালাশ.কমঃউজ্জ্বল কুমার সরকার নওগাঁঃনওগাঁর মহাদেবপুরে নিবন্ধিত সমবায় সমিতির নানান অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। উপজেলা সমবার কার্যালয় সমিতিগুলোর আমানত সংগ্রহ, অতিরিক্ত হারে আমানতের সুদ প্রদান, সমিতির সদস্যদের বাইরে ঋণ প্রদান, ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত হারে সুদ গ্রহণ, ঋণের মেয়াদ এক বছরের বদলে একশ’ দিন করা, প্রতিমাস অথবা প্রতিসপ্তাহের বদলে প্রতিদিন কিস্তি আদায়, অনুমোদিত এলাকার বাইরে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা, বেআইনী শাখা খোলা প্রভৃতি নানান বিষয়ে সমিতিগুলোকে সতর্ক করেছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানানো হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন যে, সম্প্রতি উপজেলার আনাচে কানাচে ব্যাঙের ছাতার মত নানান বাহারী নামে অসংখ্য সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছে। এসব সমিতি উপজেলা সমবায় দপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে বেআইনীভাবে মোটা অংকের সুদ দেয়ার লোভ দেখিয়ে সমিতির সদস্যের বাইরে যে কোন ব্যক্তির কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করছে। সরকারি ব্যাংকগুলো যেখানে বছরে এক অংকে সুদ দিয়ে থাকে সেখানে ওই সমিতিগুলো বেআইনীভাবে প্রতিমাসে প্রতিলাখে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রতিবছর ২৪ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হারে সুদ দিচ্ছে। কিছুদিন সুদ দেয়ার পর কোন কোন সমিতি গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সমবায় সমিতির নিয়মানুযায়ী সমবায়ী প্রত্যেক শেয়ার হোল্ডার সদস্যের সমান সঞ্চয় থাকবে। কিন্তু যার কোন শেয়ার নেই তার কাছ থেকেও সঞ্চয় নেয়া হচ্ছে। সমিতির শেয়ার হোল্ডার সদস্য ছাড়া অন্য কেউ ঋণ পাবার আইন না থাকলেও তারা যে কাউকে ঋণ দিচ্ছে। প্রতিজন শেয়ার হোল্ডার তার শেয়ারের ৪০ গুণ পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। কিন্তু শেয়ার হোল্ডাররা কোন ঋণ নেননা। প্রতিটি ঋণ কমপক্ষে একবছর মেয়াদী হবার বিধান থাকলেও সমিতিগুলো বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে একশ’ দিনের মেয়াদে। আর কিস্তি নেয়া হচ্ছে প্রতিদিন। আইনে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ হারে সুদ নেয়ার বিধান থাকলেও তারা একশ’ দিনের শেষ দিন পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে ১০ শতাংশ হারে। বছরে এটা পড়ছে ৩৬ শতাংশে। আবার প্রতিদিন কিস্তি নেয়ায় এই সুদের হার প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছছে।
সমিতিগুলোর নিবন্ধনের সময় নিজস্ব উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনার শর্ত থাকলেও অনেক সমিতির নিজ উপজেলার বাইরেও কার্যক্রম চালাচ্ছে। জেলা সদর থেকে নিবন্ধন নিয়ে অনেকে জেলার অন্য উপজেলাগুলোতে শাখা খুলে এসব কাজ করছেন। সংশোধীত আইনে নিবন্ধিত সমিতিগুলোর শাখা পরিচালনা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সমিতিগুলো সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই শাখা কার্যালয়গুলো চালু রেখেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতবছর জাতীয় সমবায় দিবসে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতির পুরস্কার পাওয়া সাতরং সমবায় সমিতি প্রায় চার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কিন্তু গ্রাহকদের সে টাকা ও সুদ ফেরৎ দিতে না পারায় এর পরিচালক সুহেল চৌধুরী গতমাসে আত্মহত্যা করেন। উপজেলা সদরের মধ্যবজারের নদী সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি গ্রাহকের ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয় নিয়ে গতমাসে পালিয়ে গেছে। ব্যতিক্রম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, প্রগতি কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতিসহ কয়েকটি সমিতি কয়েকশ’ গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা সঞ্চয় নিয়ে ফেরৎ না দিয়ে পালিয়ে গেছে। এছাড়া নওগাঁ মাল্টি পারপাস সমবায় সমিতিসহ ৫টি সমিতি শাখা খুলে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিষয়গুলো জানাতে উপজেলা সদরের কয়েকটি সমবায় সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা এসব ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সমিতির পরিচালক জানান, এটা এখন একটা বিশাল লাভজনক ব্যবসায়। সমিতির রেজিষ্ট্রেশন নিতে পারলেই মানুষকে আমানত জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা যায়। মোটা অংকের সুদ পাবার চুক্তিতে অনেকেই মোটা টাকা লগ্নি করেন। বিশেষ করে যারা বিভিন্নভাবে কাঁচা টাকা কামাই করেন তারা ব্যাংকে না রেখে এখানে টাকা রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। অনেক সরকারি কর্মকর্তাও মোটা অংকের টাকা লগ্নি করে থাকেন। অন্যের টাকা দিয়েই ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনা করা যায়। এখানে সমিতির কর্মকর্তাদের নিজেদের টাকা লগ্নি করতে হয়না। তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সবকিছু যাচাই বাছাই না করেই সমিতিগুলোর রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছে। যারা একসময় পুরাতন সমিতির কর্মচারি ছিল তারাই এখন মালিক বনে যেখান সেখান থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে লাপাত্তা হচ্ছে।জানতে চাইলে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জানান, গত ১৯ অক্টোবর উপজেলার ৩২টি ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করা নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংগঠন মহাদেবপুর সমবায় ঐক্য ফ্রন্টের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনা করে এসব বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উচ্চ হারে মুনাফা প্রদানের চুক্তিতে আমানত গ্রহণ না করতে ও ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা না করতে একটি চিঠিও ইস্যু করা হয়েছে। তিনি জানান, এই উপজেলায় মোট ১৮৪টি নিবন্ধিত সমবায় সমিতি রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এরমধ্যে ৯৮টি সরকারি প্রকল্পভূক্ত কৃষি ও প্রাণিসম্পদ সমিতি, ৩৫টি মৎস্যজীবী সমিতি, ৫টি পানি ব্যবস্থাপণা সমিতি ও ৩টি শিক্ষক সমিতি রয়েছে। বাকিগুলো ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের শেয়ার হোল্ডার কতজন, কতজনের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কতটাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে, কতজনকে ঋণ দেয়া হয়েছে তা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রতিটি সমিতির অডিট সম্পন্ন করা হয়। প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন ফাইল রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর একসাথে তথ্য নেই।
প্রতিবছর জাতীয় সমবায় দিবসে তিনটি সমিতিকে শ্রেষ্ঠ সমিতির ও কয়েক জনকে শ্রেষ্ঠ সমবায়ীর পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু তাদের কার্যক্রম সন্তোষ জনক না হওয়ায় এবার কোন পুরস্কার দেয়া হচ্ছেনা বলেও জানান তিনি।
নওগাঁ প্রতিনিধিঃ।