দৈনিক তালাশ.কমঃ উজ্জ্বল কুমার সরকার: এক সাগর রক্তের বিনিময়ে-বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবোনা।
আজ মহান মুক্তিযুদ্ধকালের অকুতোভয় যোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী নুর মোহাম্মদ এর জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
যাদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ আজ স্বাধীন তাদেরই একজন শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখ। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।
১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে নূর মোহাম্মদ শেখ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মাতা জেন্নাতুন্নেসা। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান ফলে শৈশবেই ডানপিটে হয়ে পড়েন।
স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করেননি। নিজ গ্রামেরই সম্পন্ন কৃষক ঘরের মেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা ওরফে তোতাল বিবিকে বিয়ে করেন।
১৯৫৯-এর ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর-এ যোগদান করেন।দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই নূর মোহাম্মদকে দিনাজপুর থেকে যশোর সেক্টরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান।
১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধ চলাকালীন যশোরের শার্শা থানার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা’র নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
সেদিন ছিল ১৯৭১-এর ৫ সেপ্টেম্বর। সুতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যূহের সামনে যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে অনবরত পাল্টা গুলিবর্ষণও করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
এক সময়ে সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল.এম.জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তাঁর ডান কাঁধে যাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
শত্রুর গোলায় ধরাশয়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন নূর মোহাম্মদ শেখ। হাতের এল.এম.জিটি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেলটি শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়ে নিলেন।
যতক্ষণ না ওঁরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন ততক্ষণ ঐ রাইফেল চালিয়ে দিয়ে শত্রুসৈন্যের অগ্রসারতা ঠেকিয়ে রাখবেন এবং শত্রুর মনোযোগ তাঁর দিকেই কেন্দ্রীভুত করে রাখবেন এই মানসে।
অন্য সঙ্গীরা নুর মোহাম্মদকে অনুরোধ করলেন তাদের সাথে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাঁকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বে এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে এতটুকুও রাজি হলেন না। বাকিদের অধিনায়োকোচিত আদেশ দিলেন তাঁকে রেখে চলে যেতে।
শেষ পর্যন্ত তাঁর আদেশ অনুসরণ করে তাঁকে রেখেই নিরাপদে সরে যেতে পারলেন সহযোদ্ধারা। এদিকে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ।
এ কঠিন যুদ্ধে একদিকে পাকিস্তানী আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনী, সঙ্গে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে মাত্র অর্ধমৃত সৈনিক (ই.পি.আর.) যাঁর সম্বল একটি মাত্র রাইফেল ও সীমিত গুলি।
দোর্দণ্ডপ্রতাপের সাথে এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে নুর মোহাম্মদ নিজ বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশলে শত্রুপক্ষের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটোও উপড়ে ফেলে। সেদিন ছিলো ১৯৭১ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর।
পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে পাশের একটি ঝাড় থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। এই বীর সেনানীকে পরবর্তীতে যশোরের কাশিপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়।