গায়ের জোরে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসে বিনোদের কারসাজি

দৈনিক তালাশ ডটকমঃ নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগে শিক্ষার মুকুট হিসেবে পরিচিত মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ আজ অনিয়ম ও সংকটে জর্জরিত। অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানের একজন সহকারী শিক্ষক বিনোদ কুমার দেবনাথ এই সবকিছুর মূলে রয়েছে। তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায় ঘটছে এসব। এ নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রীরা সরাসরি প্রশাসনের কাছে নালিশ জানিয়েছে। কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এক ব্যক্তির একচ্ছত্র আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারেই ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার গুণগত মান ও শৃঙ্খলা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।

যে অভিযোগগুলো বারবার উঠেছে, সেগুলো ভীষণ গুরুতর। শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন যে, বিনোদ কুমার দেবনাথ স্কুলের রুটিনের দায়িত্ব পাওয়ার পরে নিজেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক দাবি করে। অভিযোগে বলা হয়েছে, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কোনো লিখিতভাবে প্রমাণ দিতে পারেননি; তবু সহকারী প্রধান শিক্ষকের চেয়ার বসে তিনি অফিস করেন এবং দরজায় নিজের নামে নেইমপ্লেট লাগিয়েছেন। এছাড়াও প্রতিয়াষ্ঠানের যাবতীয় নির্দেশনা তিনিই জারি করেন। অনেক অভিভাবক মনে করেন বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় অনিয়মের নেপথ্যে তিনি রয়েছেন।

এছাড়াও শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছ থেকে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিনোদ কুমার দেবনাথের কোচিং বাণিজ্য। । অভিযোগে বলা হয়েছে, বিনোদ কুমার দেবনাথের ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টারে মর্গ্যান গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের যেসব শিক্ষক ক্লাস নেয়, তাদেরকেই বেশিরভাগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে দেওয়া হয় এবং পরীক্ষার হলে কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক সুবিধা প্রদান করা হয়। এইসব অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে অভিভাবকদের কাছে অডিও রেকর্ডসহ অন্যান্য প্রমাণাদি রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও জানা গেছে, স্কুলের সাধারণ পরীক্ষায় খাতা বিক্রির টাকা থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেছেন।এই ধরনের আর্থিক দুর্নীতির তদন্তের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকবৃন্দ ।

এক তদন্তে উঠে এসেছে যে, বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি নির্বাচনের সময় অনিয়ম হওয়াতে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় নিয়মবহির্ভূতভাবে হল সুপার থাকা নিয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকরা জানান, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রভাবক ও রাজনৈতিক চাপে কমিটি রদবদল হয়নি, ফলে নিয়মিত নির্বাচন স্থগিত হয়েছে এবং অনেকেই এ বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছেন।  আদালত বা প্রশাসনিক কোনো নিষ্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও বিনোদ কুমার দেবনাথ গং দফায় দফায় অনিয়ম করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যস—জেলা প্রশাসনের এক সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিদ্যালয়ে গেলে তাকে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে আটকে রাখা হয়েছিল; এর পেছনে ছিল বিনোদ কুমার দেবনাথের উস্কানি। সেই সময় ম্যাজিস্ট্রেট ও কিছু শিক্ষকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা তৈরি হয় এবং  উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশকে আসতে হয়। এই ঘটনার বিবরণ এবং সংশ্লিষ্টদের বর্ণনা সংবাদদাতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্থানীয়রা বললেন যে ঘটনার নেপথ্যে বিনোদের প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে।
শিক্ষক ও অভিভাবকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষের তালা ভাঙা, কোনো অনুমতি ছাড়াই কক্ষ দখল করা, নেমপ্লেট বদল করা—এসব কিছু বিনোদ কুমার দেবনাথের ইশারায় হয়েছে। তারা বলেন, বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুসরত রেবেকা বিষয়গুলো জানেন, তবু স্পষ্ট কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, তিনি কার্যত নির্লিপ্ত ভঙ্গি ধারণ করছেন। অনেক অভিভাবক এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন—কেন অধ্যক্ষ সক্রিয়ভাবে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে অবহিত বা ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না; তাদের বক্তব্যে অধ্যক্ষের এই ভূমিকার জন্য জন্য হতাশা এবং সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে।

আরও যেসব গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো শিক্ষক ও স্টাফদের কাছে চাপ দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা। অনেকে জানান, যদি কেউ স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর দিতে রাজি না হন, বিনোদ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

বিনোদ কুমার দেবনাথ-সহ কতিপয়  অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পূর্বে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা থাকলেও তা থেকে অব্যাহতি নেওয়ার জন্য মুচলেকা দিয়েছিল; পরে সেই একই ব্যক্তিরা আবার একই রকম আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিভাবকরা বলেন, বিদ্যালয়ের কয়েকটি কাগজপত্র ও ভাউচারও তাদের হাতে এসেছে, যেখানে পরীক্ষার খাতা বিক্রি থেকে সংগৃহীত অর্থ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়েছে—এই ধরনের আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে তারা ফটোকপি ও রশিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে কিল্ডারগার্টেন স্কুলের অজুহাতে টাকা উত্তোলনের কথাও জানা যায়। অভিভাবকরা বলছেন, এসব বিষয়ে তদন্তপূর্বক শনাক্তকরণ হওয়া দরকার।

শিক্ষক ও ছাত্রীরা সরাসরি বলছেন যে, বিনোদ ক্ষোভপ্রবণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করে থাকেন; সামান্য বিরোধিতা করায় তিনি কিছু শিক্ষককে শোকজ দেন। এমনকি বরখাস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি বিদ্যালয়ের কিছু প্রযুক্তি সুবিধা নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন— যেমন সিসি ক্যামেরার পাসওয়ার্ড নিজের কাছে রেখে মনিটরিং করছেন, এবং বিদ্যালয়ের রুম ডিউটি ও পরীক্ষা কমিটি গঠনেও তার পছন্দের লোকদের স্থান দিচ্ছেন। এই কথাগুলো প্রমাণ হিসেবে অনেকেই অডিও ও ভিডিও ক্লিপের কথা উল্লেখ করেছেন।

বিনোদ সহ কতিপয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বা বহিরাগত লোকদের ব্যবহার করার  গুরুতর অভিযোগ আছে। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, কিছু সময় বিনোদের কক্ষে এলাকায় পরিচিত সন্ত্রাসী ও অপরাধ মামলা জড়িত ব্যক্তিদের প্রবেশের দৃশ্যধারণ করা হয়েছে এবং তাদেরকে ওই কক্ষে রেখে গোপনীয় নথিপত্র দেখানো হয়েছে। সাক্ষ্য হিসাবে ভিডিও ও স্থিরচিত্র সংযুক্ত আছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব চিত্র ও তথ্য যাচাই করে দেখা প্রয়োজন বলে স্থানীয় সচেতন মহল জানিয়েছেন।

অভিভাবকরা নেপথ্যে বলেন যে বিনোদ তার নিজের কোচিং সেন্টারের শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দেয় এবং নিজের নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রীদের পাস করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বিদ্যালয়ের প্রাক-নির্বাচনী ফলাফলে কিছু সংখ্যক অকৃতকার্য থাকা সত্ত্বেও বোর্ড পরীক্ষায় শতাধিক অকৃতকার্য হওয়ার বিস্তর প্রশ্ন থেকে যায়—এই ফলাফল বিশ্লেষণও অন্য এক ধরনের প্রশ্নবোধ তৈরি করেছে।

এই সব অভিযোগ নিয়ে আমাদের সাংবাদিক দল বিদ্যালয় প্রশাসনকে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুসরাত রেবেকা ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের প্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগের কাগজপত্র ও অভিভাবক-শিক্ষকরা যে প্রমাণ দেখিয়েছেন তা নিয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তারা তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো লিখিত প্রতিকার দেখাননি। জেলা প্রশাসক অথবা সভাপতি মহোদয়ের অনুমতি ছাড়া পদবী পরিবর্তন বা নেইমপ্লেট বসানো সংক্রান্ত যে দাবী করা হয়েছে, তা যাচাই-বাছাই হওয়া প্রয়োজন।

স্থানীয় গণমাধ্যম ও সচেতন মহল দাবি করছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যাতে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনে, তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে একটি সংবিধিবদ্ধ তদন্ত প্রয়োজন। অভিভাবকরা আশা করেন যে জেলা প্রশাসন, শিক্ষা বোর্ড ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিলিয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেবে এবং বিদ্যালয়ের শৈশবসংক্রান্ত স্বার্থ ও শিক্ষার মান রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজটির বহু প্রজন্মের স্মৃতি ও সাফল্য কেবল একটি ব্যক্তির আত্মসাৎ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিনিময়ে হারানো উচিত নয়। স্থানীয় জনগণ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা এখন অপেক্ষা করছেন নিরপেক্ষ তদন্তের এবং দ্রুত, ন্যায়িক ব্যবস্থা গ্রহণের। স্কুলটির ভবিষ্যত, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানের সম্মান বজায় রাখতে প্রশাসনকে দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।

এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করার সময় উল্লিখিত অভিযোগসমূহ ও প্রমাণাদি—অডিও রেকর্ড, ভিডিও ক্লিপ, ভাউচার কপি ও অভিভাবক-শিক্ষকদের লিখিত বিবৃতি—সংরক্ষিত হয়েছে। তদন্তকারীরা প্রয়োজনে এগুলো যাচাই করে প্রকৃত দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। স্কুল, অভিভাবক ও জেলার শিক্ষা পরিবেশ স্বচ্ছ ও নিরাপদ রাখাটা এখন সময়োপযোগী কর্তব্য।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *