সূর্যস্রষ্টা সুরকার সুবল দাসের শুভ জন্মদিন

দৈনিক তালাশ.কমঃ উজ্জ্বল কুমার সরকারঃ আজ ২৭ ডিসেম্বর সূর্যস্রষ্টা সুবল দাস এর জন্মদিন।

“জীবনও আধারে, পেয়েছি তোমারে/ এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেওনা/ গানেরই খাতায় স্বরলিপি/ শিল্পী আমি শিল্পী/ যখন থামবে কোলাহল ঘুমিয়ে নিঝুম চারদিক কিংবা ওরে ও বাঁশিওয়ালা অথবা মনেরই ছোট্ট ঘরে এই কালজয়ী গানের সুরকার সুবল দাস।”
সুবল দাস ছিলেন একজন বাংলাদেশী খ্যাতিমান জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। তার কিছু কিছু গানের সুরের ইন্দ্রজালে এখনো শ্রোতারা বিমোহিত হয়।
তার সুর করা অনেক হৃদয়ছোঁয়া গান এখনও শ্রোতাদের মাঝে অন্যরকম মুগ্ধতা ছড়ায়। একসময় দেশের ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির প্রাণ ছিলেন সুরকার সুবল দাস।
সুবল দাসের জন্ম ১৯২৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর। কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তিতাস নদীর পাড়ে কাটে তার শৈশব-কৈশর। তার বাবার নাম রসিক লাল দাস আর মায়ের নাম কামিনী দাস।
সুবল দাসের আসল নাম ছিল সুকুমার চন্দ্র দাস। পরবর্তীতে সুবল দাস নামে তিনি সর্বত্র জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
সঙ্গীতের তার হাতে খড়ি ছিল একেবারে শৈশবে। পরিবারের সবাই গানবাজনা ভালোবাসতেন বলেই গানের সাথে তার যোগসূত্র তৈরি হতে সময় লাগেনি। তবে জীবনের শুরুতে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন মূলত যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে।
সেতার বাদক হিসেবে ওস্তাদ ইসরাইল খাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। ওস্তাদ ইসরাইল খাঁ ছিলেন প্রখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভাগ্নে। পরবর্তীতে ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছ থেকে যন্ত্রসঙ্গীতের ওপর তালিম নেন তিনি।
সঙ্গীতের পাশাপাশি এই একই সময়ে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবেও তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। সঙ্গীত এবং ক্রীড়াঙ্গনে যুগপৎ নিজেকে মেলে ধরতেই একসময় তিনি কুমিল্লা থেকে রাজধানী ঢাকাতে চলে আসেন।
তৎকালীন বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের গোলরক্ষক হিসেবে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি বড় বেশি আগ্রহ থাকায় একসময় ফুটবল খেলা ছেড়ে দেন। ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে আত্মনিয়োগ করেন শুধু সঙ্গীতেই।
পরিপূর্ণ একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন মূলত ১৯৫৯ সালে। এ বছরে তার সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম মুক্তি লাভ করে ফতেহ লোহানী পরিচালিত চলচ্চিত্র, আকাশ আর মাটি।
এফডিসির তত্ত্বাবধানে নির্মিত এটিই ছিল এদেশের প্রথম ছবি। উল্লেখ্য এই একই বছরে নির্মিত হয়েছিল আকাশ আর মাটিসহ মাত্র চারটি ছবি।
অন্য ছবিগুলো হলো: মহিউদ্দিন পরিচালিত মাটির পাহাড়, এহতেশাম পরিচালিত: এদেশ তোমার আমার এবং এজে কারদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাবেরা।
এই ছবিতে কামাল লোহানীর সাথে সুবল দাস প্রথম কাজ শুরু করেন ১৯৫৭ সালে। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করতে গিইে সুবল দাসের সাথে প্রথম সাক্ষাত ঘটেছিল ভারতের বিখ্যাত গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের।
১৯৬৩ সালে সুবল দাস সঙ্গীত পরিচালনা করেন মসউদ চৌধুরী পরিচালিত: প্রীত না জানে রীত। এ ছবিটিও সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ৬৫ সালে সঙ্গীত পরিচালনা করেন নজরুল ইসলাম পরিচালিত কাজল চলচ্চিত্রের।
৬৭ সালে সঙ্গীত পরিচালনা করেন ভানুমতি এবং আলীবাবা ছবির। এ ভাবেই নিজের প্রতিভা বিকশিত করে আস্তে আস্তে এগুতে থাকেন তিনি। এই দশকের শেষ লগ্নে সুবল দাস বলা যায় সিনেমার গানে এক অন্যরকম পরিবর্তন আনেন হৃদয় ছোঁয়া কিছু গান সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
’৭০ সালে তার সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তি পায় রফিকুল বারি চৌধুরী পরিচালিত: তানসেন, নজরুল ইসলাম পরিচালিত দর্পচূর্ণ এবং স্বরলিপি এবং রহিম নেওয়াজ পরিচালিত- যোগবিয়োগ সিনোমা।
এ সময়ে দারুণ এক উত্থান ঘটে সুবল দাসের। সুরকার সুবল দাস-ই স্বরলিপি ছবিতে রুনা লায়লাকে দিয়ে- গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে…এই গানটিতে প্লেব্যাক করান। স্বরলিপি ছবির সবকটি গানই এখনও সেই আগের মতোই জনপ্রিয় হয়ে আছে।
আশির দশকে সিনেমার সঙ্গীতে অন্যরকম এক পরিবর্তন আনেন সুবল দাস। সামাজিক ছবির বদলে অনেকটা বাণিজ্যিক ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। সেখানেও তিনি দারুণভাবে সফল হন।
এ সময়ে এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত রাজমহল, শীষনাগ, পদ্মাবতী, সওদাঘর, নরমগরম এ সব ছবিতে এক অন্যরকম সুরের ঝংকার তুলেন তিনি।
পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে তার সঙ্গীত পরিচালনায় গায়ের ছেলে, অনুরাগ, বানাজারান, পুত্রবধূ, দোস্তি, হারানো মানিক, লালুভুলু, ঝুমুর, গৃহলক্ষীর মতো সামাজিক-পারিবারিক ছবিও সুপার হিট করে।
ওই সময় এফ কবির চৌধুরীর পদ্মাবতী, সওদাগর, নরমগরম ছবিতেও তিনি অসাধারণ কিছু মিষ্টি গান সৃষ্টি করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেওনা, ওরে ও বাঁশিওয়ালা, মনেরই ছোট্ট ঘরে।
এ সব গানের বাইরে রুনা লায়লার কণ্ঠে তার সুরের অজস্র আধুনিক গান অন্যরকম জনপ্রিয় হয়ে আছে শ্রোতাদের হৃদয়ে আজও । বিশেষ করে রুনা লায়লার গাওয়া: শিল্পী আমি শিল্পী, তোমাদেরই গান শোনাবো এই গানটি সুবল দাসেরই একঅন্যরকম সৃষ্টি।
যে কোনো স্টেজে রুনা লায়লা গান গাইতে দাঁড়ালে এ গানটি গাওয়ার জন্য শ্রোতাদের অনুরোধ আসবেই। রুনার গাওয়া, যখন থামবে কোলাহল, পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম বন্ধুর ভাগ্যে হইল না, এ সব জনপ্রিয় গানের সুরকারও সুবল দাস।
সুবল দাস ছিলেন সত্যিকার অর্থে মিষ্টি সুরের এক ঐন্দ্রজালিক স্রষ্টা। মেলোডিয়াস গানের প্রতি দারুণ রকম দুর্বল ছিলেন তিনি। কেউ মেলোডিয়াস সমৃদ্ধ গান করলে তার অকুন্ঠ প্রশংসা তিনি সবসময়ই করেছেন।
সুবল দাস মনে করতেন বাঙালি ঘরানায় মেলোডিয়াস গানের অগ্রদূত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড রকম অন্তর্মুখী এক মানুষ ছিলেন সুবল দাস। প্রচার-প্রচারণায় একদমই বিশ্বাস করতেন না।
আর এ কারণেই সঙ্গীতে তার অনেক অবদান থাকলেও তিনি খানিকটা অপ্রকাশিত থেকে গেছেন। নিরংহকারী এবং উদার মনের মানুষ হিসেবেও তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। সুবল দাস ২০০৫ সালের ১৬ অগাস্ট মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করা হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। দেশের সঙ্গীতের জন্য সারাজীবন সাধনা আর পরিশ্রম করে গেলেও তার মৃত্যুতে সেসময় শোক প্রকাশ করেনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কেউ।
শুধু এই নয়, এখনও পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি তাঁকে। নিজের সৃষ্টির মাঝেই কেবল অমরত্ব লাভ করে আছেন তিনি। সুবল দাসের সুর করা কিছু জনপ্রিয় গান, এই পৃথিবীতে তবে কী আমার নেই কোনো ঠাঁই-মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যয়, তুমি যে আমার কবিতা-মাহমুদুন্নবী, ও মেয়ের নাম দিব কী ভাবি শুধু-মাহমুদুন্নবী, এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে এসে গান-মাহমুদুন্নবী। তাছাড়া, আমি সাতসাগর পাড়ি দিয়ে-মাহমুদুন্নবী, আমি মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছি-প্রবাল চৌধুরী, এক অন্তবিহীন স্বপ্ন ছিল- মাহমুদুন্নবী, যদি বউ সাজগো-রুনা লায়লা-খুরশীদ আলম, সামাল সামাল সামাল সাথী- সৈয়দ আব্দুল হাদী, সন্ধ্যারও ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়ায়-সাবিনা ইয়াসমিন। সুবল দাস এর সুরে, জীবনও আধারে, পেয়েছি তোমারে-রুনা লায়লা, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেওনা-রুনা লায়লা, গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে-রুনা লায়লা, শিল্পী আমি শিল্পী-রুনা লায়, যখন থামবে কোলাহল -রুণা লায়লা ইত্যাদি। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
নওগাঁ #

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *