উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের শুভ জন্মদিন

দৈনিক তালাশ.কমঃ উজ্জ্বল কুমার সরকারঃ ২ আগষ্ট উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের জন্মদিন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের আদিপুরুষ হীরালাল সেন। হীরালাল সেন ১৮৬৬ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার-বগজুরি গ্রামের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মায়ের ২য় সন্তান হীরালাল সেন প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষার পথে না গিয়ে ছবির জগতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি তখন একজন দক্ষ মেধাবী ফটোগ্রাফার হয়ে উঠেছিলেন। এবং ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় সাতবার জিতে নেন সোনার মেডেল। হীরালাল সেন তখন ফটোগ্রাফিতে ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে খুবই পরিচিত এবং অপরিহার্য নাম।

ঠিক এই সময়টাতেই ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় চলমান ছবি (চলচ্চিত্র) আবিষ্কার ক’রে এক যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেন। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের আবিষ্কৃত চলচ্চিত্র সে সময় কলকাতাও প্রদর্শিত হয়। যুবক হীরালাল সেন এই চলচ্চিত্র দেখে স্থীর ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর কাছে নিরর্থক মনে হয় স্থীর ছবি তোলা। এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি চলমান ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েন। এবার শুরু হয় তার নতুন যাত্রা। তিনি এর মধ্যেই চলচ্চিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেন। অতঃপর একমুহূর্ত সময় আর নষ্ট না ক’রে,মায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এবং ভাই মতিলাল সেনকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে। মায়ের কাছ থেকে নেওয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ইংল্যান্ড থেকে একটা মুভি ক্যামেরা ক্রয় করেন। অতঃপর জোরেশোরে শুরু ক’রে দেন তাঁর কর্ম তৎপরতা। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের সিনেমা আবিষ্কারের ঠিক তিন বছর পরই তৎকালীন ভারববর্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো কঠিন যাত্রা পথের সূচনা করেন বাঙ্গালি যুবক হীরালাল সেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার,দাদা সাহেব ফালকে ভারতবর্ষে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন! কিন্তু প্রকৃত ঘটনা, দাদা সাহেব ফালকের প্রথম ছবি ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ নির্মিত হয় হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র যাত্রা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্তত ১৩ বছর পর।
১৯০১সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত হীরালাল সেনের নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির সংখ্যা ৪০টি। ১৯০৩ সালে তাঁর ‘রয়্যাল বায়স্কোপ’ কোম্পানি থেকে সিকে সেনের মাথার তেল ‘জবাকুসুম’ বট ফেস্ট পালের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ ও ডব্লিউ মেজর কোম্পানির ‘সালসা পিলা’ প্রভৃতি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করা হয়। তিনি আলিবাবা ৪০ চোর (Alibaba and the forty thieves) নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন১৯০৪ সালে। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম একটি রাজনৈতিক এবং তথ্য চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় কলকাতায় প্রতিবাদ সভার ডাক দেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেই সময় আয়োজন করা হয় একটা মহামিছিলের। হীরালাল সেন সেই সময় কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভা সমাবেশ,মিছিল মহা মিছিল সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তার চলমান ক্যামেরায় ধারণ করেন। এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দেশপ্রেমিক বঙ্গ সন্তান হিসেবে শক্তিশালী জায়গা ক’রে নেন। তাঁর নির্মিত এই রাজনৈতিক এবং তথ্যচিত্রের তিনি নামকরণ করেন,”Anti-partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905.” এই ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলো “আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা”।
হীরালাল সেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী রাজনৈতিক এবং তথ্য চিত্র নির্মাণ করে এক যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেন সে সময়। এরপর তিনি বাঙালী ধীবর,জেলের ছেলে সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯১১ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘দিল্লি দরবার’ ছবিটি। দিল্লি দরবার ছবিটি কলকাতায় প্রদর্শিতও হয়েছিলো। মৃত্যুর চার বছর আগে ১৯১৩ সালে ভাই মতিলাল সেনের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন মতবিরোধে। এরই পরিণতিতে দু’ভাই উঠে যান ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে। হীরালাল সেন উঠে যান ১৮ নম্বর ব্ল্যাকি স্কোয়ারের বাড়িতে। মতিলাল সেন উঠে যান রায় বাগানের ভাড়া বাড়িতে। রায় বাগানের এই ভাড়া বাড়ির নিচতলার গুদামেই ছিলো রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানির সমস্ত চলচ্চিত্র সরঞ্জাম এবং চলচ্চিত্রের প্রমান সমূহ। তার মানে এই গুদামেই ছিলো হীরালাল সেনের সারা জীবনের সমস্ত সিনেমা।
১৯১৭ সালের ২৪ অক্টোবর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এই গুদামেই শেষ হয়ে যায় হীরালাল সেনের সারা জীবনের সম্পদ।। এই ক্ষতি আর কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি ভারতীয় সিনেমার মহান স্রষ্ঠা হীরালাল সেন। স্বাভাবিক কারণেই এরপর তিনি অর্থনৈতিক টানপোড়েনে জড়িয়ে পড়েন। আর্থিক অনটনের মধ্যেই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
নওগাঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *