এত্তো কাঁদালি দোস্ত ভালো থাকিস ওপাড়ে

দৈনিক তালাশ.কমঃ উজ্জ্বল কুমার সরকার নওগাঁঃ গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার বাদ জোহর মহাদেবপুর হাইস্কুল মাঠে মহাদেবপুরের বিশিষ্ট তিনজনের জানাযা হয় একসাথে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াছাৎ হায়দার টগরের ছোট ভাই হায়দার এমদাদ হোসেন পলাশ (৬২), এ্যাডভোকেট আফসার আলীর ছেলে এ্যাডভোকেট আমিরুস সাদাত নোবেল (৪৩), আর কুশারসেন্টার পাড়ার রফিকুল ইসলামের। তুই ছিলি জানাযার প্রথম সারিতে। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সেটাই মানান। আর আমি ছিলাম তোর পিছনে একটু দূরে। নামাজ শেষে আমার ডায়াবেটিস কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেওয়ায় পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মুখে দিই। সামনে তোকে দেখতে পেয়েছি, কিন্তু ডিসটার্ব দিইনি। তুই বসেছিলি ঢালাই করা বেঞ্চে। পাশে ছিল এক মুরব্বি। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুই ডাকলি,

: একাই খাচ্ছু ক্যা ? দে।
পকেটে হাত দিলাম। ভাগ্যিস ছিল। দুটাই। বের করে তোকে একটা দিলাম, মুরব্বিকে একটা। মনের অজান্তেই বললাম,
: বয়স তো আমাদেরও হলো রে।
রীতিমত চেঁচিয়ে উঠলি,
: ভয় দেখাচ্ছু ক্যা ? দেখ দিনি কতো বয়স হইচে! (পাশের মুরব্বিকে দেখিয়ে দিলি, ৮০ পার, আর আমাদেরতো ৬০, তোর জন্ম ১৯৬৪ সালের ২০ জানুয়ারি, আর আমার ১৩ মে)।
আমি আলাপটা আর একটু টেনে নিলাম,
: খবর কি ? (ভোটের কথা বলছি, তা তুই ঠিকই বুঝেছিলি)
: কি আর হবে, যা আছে তাই। তোরা আমার লোক, আমারই থাকবি। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর তুই তোর কাজে, আমি আমার। এর মাত্র ২ মাস ১৭ দিনের মাথায় গত ২০ এপ্রিল তুই আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেলি। সেদিনের কথা ভূলবোনা যতদিন আমিও না যাচ্ছি। আমি তো সেদিন বুঝে বলিনিরে। কথাটা আমার উপরও আসতে পারে! তুই বল, একথা মনে হলে কার না কান্না পাবে ? জয়পুর ডাঙ্গাপাড়ায় তোর লাইভ দেখাতে দেখাতে কেঁদে বুক ভাঁসিয়েছি। কেউ দেখেনি। এসে দেখে যা দোস্ত, তোর জন্য কতজন কেঁদে কুল হারাচ্ছে আনাচে কাঁনাচে।
তোর বাড়ির সামনে বকের মোড়ে প্রায়ই গভীর রাতে তোর দেখা পেতাম। কথা হতো আমার আর মিলনের সাথে। তোকে আমি বার বার বলতাম
: ভোটে দাঁড়াস না কেন?
: নারে, যদি জিততে না পারি, তাহলে সম্মান যাবে।
: ভোট লাগবেনা, এমনিই তো হবি। তুই তাতে কোনদিন সায় দিসনি। বলেছিলি
: মানুষ যেদিন ভোট দিবে, সেদিনই দাঁড়াবো।
সত্যি তাই, আমি বিএনপি করলেও তোর দোস্ত হিসেবে তোর ভোট করেছি। এই ভাগ্য কজনের হয় যে, ভোট চুরি না করেই জিতেছে ? তোর জন্য চুরি করতে হয়নি।
এর দামও তুই দিয়েছিস। আমার ডেল্টা টাইমসের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তোকে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম,
: দল টল বুঝিনা, তুই আমার দোস্ত, আমার অনুষ্ঠানে তোকে আসতে হবে।
তুই কথা দিয়েছিলি। কিন্তু তোর দলের, আর আমার সাংবাদিকদের গ্রুপিং তোকে নানাভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। শেষ মূহুর্তে তোর ফোন বন্ধ পেয়ে আমিও ভেবেছিলাম আসবিনা। কিন্তু ঠিক সময়মতই এসেছিলি। আমার প্রতিপক্ষদের মুখে চুনকালি পড়েছিল সেদিন।
তুই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার চার মাস পর তোর চেম্বারে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ম্যালাদিন পর আসলাম, মিষ্টি খাওয়া। তুই সেদিন একটা কাজ দিয়েছিলি। বলেছিলি
: উপজেলা চেয়ারম্যান হলো উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি। আগের চেয়ারম্যানের নাম বাদ দিয়ে সেখানে আমার নাম বসবে। কিন্তু গত চার মাস থেকে এটা পাশ হয়ে আসছেনা। ফলে এই কমিটির কোন মিটিংও হচ্ছেনা। তুই একটা নিউজ দে।
আমি বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা অফিসে খোঁজ নিই। তারা বলে,
: নতুন চেয়ারম্যানের নাম দিয়ে প্রোপোজাল জেলা অফিসে পাঠানো হয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে ফোন করলে তিনি জানান,
: প্রস্তাবটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের শিক্ষা বিভাগে যোগাযোগ করে যার কাছে এই ফাইল রয়েছে তার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন দিই। তিনি বলেন, : টিটো ভাই আপনাকে খুব ভালভাবে চিনি। আপনি আমাদের প্রিয় সাংবাদিক। এই ফাইলটির ব্যাপারে কেউ কোন খোঁজ খবরও নেয়নি। কোন তদ্বিরও করেনি। আমি এক্ষুণি এটি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ঠিক তিন দিন পরেই এসেছিল সেই কমিটি অনুমোদনের চিঠি। আমি জানিনা দোস্ত বিষয়টি তুই আরও বড় সাংবাদিকদের না বলে আমাকে কেন বলেছিলি।
একবার তুই তোর সরকারি গাড়িতে করে তোর অফিস থেকে আসছিলি। আমি উপজেলা মসজিদে যাবার রাস্তায় তোর সামনা সামনি পড়ে যাই। তুই গাড়ি থামিয়ে জানালা খুলে আমাকে বলেছিলি,
: ওই টিটু, তোর যখন যে কাজের দরকার পড়বে, তখনই আমাক কবু, আমি সাথে সাথেই তোর কাজ করে দিবো। কিন্তু ….. এর ব্যাপারে আমাক কিছু কবুনা। (আমার এক কথিত সহকর্মী অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল, তাকে একটা বড় ট্রেনিংয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করছিল।) আমাকে সতর্ক করে দিয়ে অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছিলি তুই।
একবার তুই আমাকে ভূল বুঝেছিলি। শিক্ষা অফিসের প্রকল্পের দুই কোটি টাকার অনিয়মের নিউজ করেছিলম। নিউজ ছাপা হবার পর একদিন তুই মোটরসাইকেলযোগে অফিস থেকে বাড়ি আসছিলি। আমিও মোটরসাইকেল নিয়ে উপজেলায় যাচ্ছিলাম। উপজেলার পশ্চিম গেটের কাছে তুই হোক্কাত করে আমার সামনে গাড়ি থামালি। খুবই ক্ষেপে বললি,
: তুই যে আমার বন্ধু, একথা কোথাও কবুনা।
আমিও কম যাইনা।
: ঠিক আছে, কবোনা। তুইও কসনা। ব্যস এ পর্যন্তই। হোক্কাত করে আবার গাড়ি টান দিয়ে চলে গেলি। কিছুদিন পর আমি সব প্রমাণসহ তোর অফিসে গিয়েছিলাম। সেদিন তুই আর ক্ষেপিসনি। আমি বলেছিলাম।
: ওই প্রকল্প থেকে অমুক, অমুক, এত পারসেন্টেজ পেয়েছে। তুই কি পেয়েছিস ? অথচ তুই সভাপতি। তোকে কিছু জানতেই দেয়নি ওরা।
তুই সাথে সাথেই তোর এ্যাসিস্ট্যান্ডকে ডেকে বকেছিলি। আর অনিয়ম ধরে দেয়ার জন্য এবার গালের বদলে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলি।
করোনার সময় ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম করা হচ্ছিল। চালের বস্তায় ১০ কেজির বদলে সাড়ে ৯ কেজি দেয়া হচ্ছিল। মিলন আর অন্য সাংবাদিকেরা এটা ধরে ফেলে দুই ভ্যানযোগে একদল মহিলাকে তাদের চালের বস্তাসহ উপজেলায় নিয়ে যায়। জানতে পেরে আমি তাদেরকে বিদায় করে দিয়ে তোকে খবর দিই। তুই আমাদের ডেকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে যেখানে বস্তা প্যাকেটিং করে রাখা ছিল সেখানে নিয়ে গেলি। একটি বস্তা মাপলি। পাওয়া গেলো সাড়ে ৯ কেজি। অন্য একটি মাপতে চাইলি। আমি বললাম আর মাপা লাগবেনা। তুই সব বস্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *