মহাদেবপুরে প্রশাসনের নাকের ডকাই বৃদ্ধাঙ্গালী দেখিয়ে সরকারি প্রকল্পে দেয়া হচ্ছে কাদামাটি

দৈনিক তালাশ.কমঃ উজ্জ্বল কুমার সরকারঃ নওগাঁর মহাদেবপুরে একের পর এক সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ক্ষতি করে, জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে, আইন ভেঙ্গে সরকারি প্রকল্পে দেয়া হচ্ছে কাদামাটি। ফলে একদিকে যেমন লক্ষ, লক্ষ টাকা ব্যয় করে সরকারি স্থাপনা দূর্বল হচ্ছে, চরম দূর্দশার সম্মুখিন হচ্ছেন সাধারণ জনতা, তেমনি প্রকল্পও হচ্ছে হালকা। সংশ্লিষ্টরা সরকারি প্রকল্পে মাটি দেয়ার নাম করে আইন ভেঙ্গে সে মাটি অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও আইন ভেঙ্গে মাটি কাটায় উৎসাহিত হচ্ছেন। দিনের পর দিন এই অবস্থা চলে আসলেও এর সমাধানে এগিয়ে আসছেন না কেউ। প্রশাসন বলছেন সরকারি প্রকল্পের স্বার্থে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা।

সরকারি প্রকল্পের নাম করে উপজেলার সর্বত্র দিন রাত ২৪ ঘন্টা তিনফসলী জমি কেটে, মজাপুকুরের গলামাটি তুলে, সরকারি পাকা রাস্তা ঘেঁষে, এমনকি সদ্য নির্মিত সরকারি ব্রিজের বেজমেন্ট কেটে এবং সরকারি নদী ও খাড়ি থেকে মাটি কেটে নিয়ে ইটভাঁটায় বিক্রি করছেন একটি চিহ্নিত চক্র। দিনরাত মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল করায় প্রতিটি পাকা রাস্তায় ঘন ধূলার স্তর পরে গেছে। একটু পানি পড়লেই কাদামাটিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পে কাদামাটি দেয়ায় জনসাধারণের চলাচল ও দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন দূরুহ হয়ে পড়ছে। গত ১ মার্চ বিকেলে উপজেলার উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের একটি মজাপুকুর থেকে গলা মাটি ভ্যেকু মেশিন দিয়ে তুলে খোলা ট্রাক্টরে করে পরিবহণ করছিলেন উপজেলার বকাপুর গ্রামের কালু ও তার সঙ্গীরা। তারা জানান, উপজেলা সদরের গরুহাটিতে মাটি ভরাটের সরকারি প্রকল্পে এই মাটি দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বক্কার সিদ্দিককে জানানো হলে তিনি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান সোহাগ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পুকুর মালিক ও ভ্যেকু মালিকের প্রত্যেকের ৫০ হাজার টাকা করে এবং চারজন ট্রাক্টর মালিকের প্রত্যেকের ১৫ হাজার টাকা করে মোট এক লক্ষ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু পরে ওই প্রকল্পের পুরোটাই কাদামাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানান, এখন বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া খরচ বেশি হওয়ায় বালুর পরিবর্তে মাটি দেয়া হচ্ছে।
৭ মার্চ এই চক্র উপজেলার উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের দোহালী-চকজোথহরি পাকা সড়কের চকশিবরামপুরে চকদোরাই সরকারি খাড়ির উপর সদ্য নির্মিত ৪৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজের বেজমেন্ট কেটে ও ব্রিজের গা ঘেঁষে ভ্যেকু মেশিন দিয়ে ৩০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে চুরি করে অসংখ্য ট্রাক্টরযোগে পরিবহণ করে নিয়ে যায়। তারা ওই খাড়ির উঁচু পাড় কেটে ফেলে। কয়েকদিন ধরে প্রকাশ্য দিবালোকে এই খাড়ির মাটি চুরি করে নিয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। জানতে চাইলে মাটি ব্যবসায়ী কালু জানায় গরুহাটির সরকারি প্রকল্পে এই মাটি দেয়া হচ্ছে। এখানে মাটি ভরাটের জন্য ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও সরকারি খাড়ি থেকে কেনো মাটি চুরি করতে দেয়া হবে, অথবা কেনো বালির পরিবর্তে কাদামাটি দেয়া হবে তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলার চাঁন্দাশ ইউনিয়নের চাঁন্দাশ গ্রামে সরকারি পাকা সড়ক সংলগ্ন একটি পুকুরের বিশাল পাড়ের গাছপালা কেটে ফেলে পুকুর সম্প্রসারণ করে মাটি কেটে ট্রাক্টরযোগে পরিবহণ করছিলেন এই এলাকার নান্নু নামে এক মাটি ব্যবসায়ী। এই পুকুরের কাদামাটি তুলে পুকুর পূণ:খনন করে সেগুলো দিনরাত পরিবহণ করায় মহাদেবপুর -ছাতড়া-রহনপুর আঞ্চলিক পাকা সড়ক কাদায় সয়লাব হয়ে যায়। ব্যক্তি মালিকানাধীন এই পুকুরের পাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় সরকারি পাকা রাস্তা রক্ষার জন্য ইতিপূর্বে সরকারি টাকা ব্যয় করে পাকা গাইড ওয়াল নির্মাণ করে দেয়া হয়। কিন্তু পূণ:খনন করায় সে গাইড ওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রিফত আরাকে জানানো হলে তিনি সেখানে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে পাঠান। পরে সহকারি কমিশনার (ভূমি) জানান, ওই মাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পে যাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ প্রকল্পের নাম করে এখান থেকে মাটি কেটে বিভিন্ন ইটভাঁটায় বিক্রি করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আত্রাই নদী ড্রেজিং ও বাঁধ পূণ:নির্মানের কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার অন্যস্থান থেকে মাটি এনে বাঁধ পূণ:নির্মাণ করবেন। কিন্তু ঠিকাদারের লোকজন প্রচলিত আইন না মেনে নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন পূর্বানুমতি না নিয়েই একের পর এক স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে প্রকল্পের কাজ করছেন। এরআগে এই প্রকল্পের জন্য মহিষবাথানে পাকা সড়ক সংলগ্ন, দেবীপুর, আদ্যাবাড়ি, পন্ডিতপুর প্রভৃতি স্থানে তিনফসলী জমি গভীর করে কেটে পুকুর খনন করে মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে। এমনকি নদীর ড্রেজিং করা লাল কাদামাটি তুলেও এই বাঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই পুরো বাঁধ কাদায় কাদাময় হয়ে থাকে। ফলে বাঁধের উপর দিয়ে সবরকম যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি পাড়ের আশেপাশের লোকজন বাঁধের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটেও চলাচল করতে পারেন না। বর্ষার সময় তারা একরকম গৃহবন্দী অবস্থায় দিন যাপন করেন। স্থানীয়রা বলছেন, সরকারি প্রকল্পে ঠিকাদার বৈধভাবে মাটি দিতে বাধ্য। এজন্য তিনি উপযুক্ত দাম পাবেন। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আইনগতভাবে মাটি কাটার অনুমতিও নিতে পারেন। কিন্তু তা না করে বেআইনীভাবে সরকারি প্রকল্প কেন পরিচালিত হবে তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না কেউ। এনিয়ে জনমনে দারুন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি প্রকল্পে সরকারি আইন ভেঙ্গে কাজ হওয়াকে সরকারি যন্ত্রের চরম ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *