দল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, পুলিশের কঠোর মনোভাব, নেতাকর্মীদের আত্মগোপন, কারাভোগ ও হতাশার কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তারা এও দাবি করছেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘোষণা দিয়ে আসে না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোল।
নির্বাচনের পরের দুদিন এবং গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে নেতাকর্মীদের মুক্তি ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বাতিলের দাবিতে বিএনপি ছয়দিনের লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচিতে বরাবরের মতো সরব রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদ্য কারামুক্ত সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে দেখা যাচ্ছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আগামী কমিটির পদপ্রত্যাশী গুটিকয়েক নেতা এবং শ্রমিক দলের একটি অংশকে দেখা যাচ্ছে।
জেল থেকে বেরিয়ে লিফলেট বিতরণে আমিনুল ইসলাম
কর্মসূচিতে কত সংখ্যক লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জাগো নিউজকে বলেন, কেন্দ্র থেকে সব ইউনিটে লেখা সম্বলিত লিফলেট ডিজাইন করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিটের দায়িত্বশীলরা নিজ উদ্যোগে তা প্রিন্ট করে বিতরণ করছেন। এ কারণে সুনির্দিষ্টভাবে লিফলেটের পরিমাণ এবং খরচ বলা সম্ভব নয়। তবে জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য যত লিফলেট ছাপানো দরকার, তাই ছাপানো হবে।
আন্দোলনের কথা না ভেবে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন
চলমান কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে সরকারের দুঃশাসনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না বলেন, মানুষ দুঃখে-কষ্টে আছে, শান্তিতে নেই। জনগণের কাছে এসব বার্তা তুলে ধরা হচ্ছে।
জনগণ শুধু নির্বাচন বর্জনই করেনি, তারা একদলীয় সরকারকেই বর্জন করেছে। বিগত তিন মাসে এ সরকার আমাদের ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছিল। তাদের আমরা নিয়মতান্ত্রিক আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করার প্রচেষ্টায় আছি। পাশাপাশি আমরা আমাদের রাজপথের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।—ড. আব্দুল মঈন খান
এক প্রশ্নের জবাবে মুন্না বলেন, আমি মনে করি না আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েছে। আন্দোলনের মাত্রা বিভিন্ন ধরনের হয়। কখন সেটা চূড়ান্ত মাত্রায় যাবে তা কেউ বলতে পারে না। আমি মনে করি, আন্দোলন আবার চূড়ান্ত মাত্রায় যাবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার বলেন, নির্বাচনের আগের কর্মসূচি এবং এখনকার কর্মসূচির ধরন ভিন্ন। এছাড়া স্বাভাবিকভাবে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। এখনো অনেক নেতাকর্মী কারাগারে, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে নেতাকর্মীদের অনেকে আত্মগোপনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কঠোর অবস্থান রয়েছে। অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। অনেকে সাজাপ্রাপ্ত। সব মিলিয়ে চলমান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম।
দলের করণীয় ঠিক করতে নির্বাহী কমিটির পর্যালোচনা সভা হওয়া দরকার বলেও মত দেন তিনি।
নির্বাচনের আগে এমন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন, এ মুহূর্তে দলের পুনর্গঠন খুবই জরুরি। সেটি যোগ্য সাংগঠনিক ব্যক্তিদের দিয়ে হতে হবে। কিন্তু সেটা না করে বিভিন্নজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। নেতাকর্মীদের কর্মসূচিমুখী করতে হলে সাংগঠনিকভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। এ কারণে মনোনয়নের ক্ষেত্রে অর্থ ও বিত্তশালীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটার এক ধরনের যৌক্তিকতা থাকে। কিন্তু সাংগঠনিক কাজে অর্থের দরকার নেই। সাংগঠনিক কাজে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরই প্রাধান্য থাকা উচিত। তা না হলে সংগঠনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট নিয়ে সরব আওয়ামী লীগ, নীরব বিএনপি-জামায়াত
এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়, দৃশ্যমান এমন কোনো পদক্ষেপ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে মাঠে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। সে অপেক্ষার পাশাপাশি বিরোধীদল হিসেবে নিয়ম রক্ষার কর্মসূচিতেই আপাতত সীমাবদ্ধ থাকবে বিএনপি। তবে দলের চলমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার ছাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে যারা সাড়া দিয়ে মামলায় হাজিরা দেননি, তারা এখন কী করবেন, তা নিয়েও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
আমরা অর্জন করেছি যেটা চলমান আন্দোলনে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে চলমান লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি।—রুহুল কবির রিজভী
দলটির নেতাকর্মীদের একটি অংশের মতে, এ মুহূর্তে দলের নেতাকর্মীদের কারামুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। করণীয় ঠিক করতে নির্বাহী কমিটির সভা হওয়া দরকার। অথচ এসব হচ্ছে না। যে কারণে আন্দোলনের জৌলুস নেই, কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিত অর্জন হচ্ছে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা অর্জন করেছি যেটা চলমান আন্দোলনে, জনগণ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে চলমান লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, গত দেড়যুগ মানুষের অধিকার ও বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করছে বিএনপি। কোনো কোনো জায়গায় সফল হয়েছে, আবার কোথাও হয়তো ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি বা কর্মীরা হতাশ নয়। জনগণ আমাদের সমর্থন দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে আমরা হেরেছি।
বর্তমান নয়া কিসিমের সংসদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। ২৮ অক্টোবরের পর লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জেলখানায় মারা গেছেন ১৩ জন। এ আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে না। আমরা জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি।—জয়নুল আবদীন ফারুক
তিনি বলেন, বর্তমান নয়া কিসিমের সংসদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। ২৮ অক্টোবরের পর লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জেলখানায় মারা গেছেন ১৩ জন। এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে না। আমরা জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি।
নয়াপল্টনে রিজভীর নেতৃত্বে লিফলেট বিতরণ
চলমান কর্মসূচির মূল্যায়ন জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আছে। আমরা জনগণের কাছে আবেদন করেছিলাম যেন তারা নির্বাচনের সার্কাস বর্জন করে। জনগণ শুধু নির্বাচন বর্জনই করেনি, তারা একদলীয় সরকারকেই বর্জন করেছে। বিগত তিন মাসে এ সরকার আমাদের ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছিল। তাদের আমরা নিয়মতান্ত্রিক আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করার প্রচেষ্টায় আছি। পাশাপাশি আমরা আমাদের রাজপথের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, লিফলেট বিতরণ, কালো পতাকা মিছিল এবং সব ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের এ প্রতিবাদ চলতেই থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জনগণের ভোটের অধিকার, মানবাধিকার তথা পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে না পারি, ততক্ষণ এ আন্দোলন চলবে।