দৈনিক তালাশ.কমঃউজ্জ্বল কুমার সরকার:বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্বভাবকবি গোবিন্দ চন্দ্র দাস এঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
গোবিন্দচন্দ্র দাসের কবিতায় উঠে এসেছে আমাদের সাধারণ জনগণের সুখ দুখ ও জীবনের বিভিন্ন বিষয়। এমনকি তার কবিতায় আমাদের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথাও ফুটে উঠেছে।
গোবিন্দচন্দ্র দাস ১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকা জেলার ভাওয়ালের জয়দেবপুরে এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তাঁর পিতা রামনাথ দাসের মৃত্যু হলে দুঃখ-দৈন্যের কারণে গোবিন্দচন্দ্র উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।ভাওয়ালরাজ প্রতিষ্ঠিত জয়দেবপুর মাইনর স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পাস করে তিনি ঢাকা নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু নবম শ্রেণি পাঠের পর স্কুল ত্যাগ করে ভাওয়ালের ব্রাহ্মণগ্রাম বঙ্গ বিদ্যালয়ে হেড পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি পর্যায়ক্রমে ভাওয়াল এস্টেটের রাজকুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি (১৮৭৭), সুসঙ্গ দুর্গাপুরের জমিদারির খাজাঞ্চি (১৮৮০), মুক্তাগাছার জমিদারির সেরেস্তাদার (১৮৮০-৮২) হিসেবে চাকুরী করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এছাড়া গোবিন্দচন্দ্র দাস ময়মনসিংহ এন্ট্রান্স স্কুলের পন্ডিত, ময়মনসিংহ সাহিত্য-সমিতির অধ্যক্ষ (১৮৮২-৮৪) এবং শেরপুরের জমিদার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক চারুবার্তার কর্মাধ্যক্ষরূপে (১৮৮৪-৯৪) দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি ময়মনসিংহ ত্যাগ করে কোলকাতা চলে যান। ৮৭-৮৮ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে গোবিন্দচন্দ্র দাস মাসিক পত্রিকা বিভা প্রকাশ করেন।গোবিন্দচন্দ্রের মধ্যে এক ধরনের প্রতিবাদী চেতনা কাজ করত। এজন্য তিনি অনেক সময় বিপদগ্রস্তও হয়েছেন। তিনি যখন ভাওয়াল স্টেটে চাকরি করতেন তখন রাজাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেন।
এমনকি ভাওয়াল স্টেটের দীউয়ান কালীপ্রসন্ন ঘোষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করায় সেখান থেকে তিনি ভাওয়াল স্টেটের দীউয়ানের চক্রান্তে বিতাড়িত হন।পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তখন নব্যভারত-এর সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাঁর আশ্রয়ে থেকেই তিনি মগের মুলুক নামক সুপ্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।অপরিসীম দারিদ্রে্যর মধ্যে গোবিন্দচন্দ্রের সমগ্র জীবন অবিবাহিত হয়, যার ছায়াপাত ঘটেছে তাঁর কবিতায়।রবীন্দ্রনাথের সমকালে আধুনিক গীতিকবিতার ধারায় কবিতা রচনা করেই গোবিন্দচন্দ্র খ্যাত হন। মধুসূদন, হেমচন্দ্র ও বন্দ্যোপাধ্যায়, রঙ্গলাল রচিত মহাকাব্যের যুগে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পর্যন্ত প্রধানত চক্রবর্তী, বিহারীলাল, গোবিন্দচন্দ্র দাস, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ কবি বাংলা গীতিকবিতার ধারাকে বজায় রেখেছিলেন।
নরনারীর ইন্দ্রিয়জ প্রেম গোবিন্দচন্দ্রের কাব্যের মুখ্য বিষয়বস্ত্ত; তবে স্বদেশপ্রেম, পল্লিপ্রকৃতি ও মানবজীবনের কথাও তাঁর কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: প্রসূন (১৮৭০), প্রেম ও ফুল (১৮৮৮), কুঙ্কুম (১৮৯২), মগের মুলুক (ব্যঙ্গকাব্য, ১৮৯৩), কস্তুরী (১৮৯৫), চন্দন (১৮৯৬), ফুলরেণু (সনেট, ১৮৯৬)।
এছাড়া আরও আছে, বৈজয়ন্তী (১৯০৫), শোক ও সান্ত্বনা (১৯০৯), শোকোচ্ছ্বাস (১৯১০) ইত্যাদি। এ ছাড়াও তিনি অ্যালেন হিউমের অ্যায়োত্রক কবিতা এবং ভগবদ্গীতার কাব্যানুবাদ করেন।গোবিন্দচন্দ্র উচ্চতর ইংরেজি বা সংস্কৃত শিক্ষার সুযোগ পাননি। তাই তাঁর কবিতা কিঞ্চিৎ অমার্জিত হলেও তীব্র আবেগ ও গভীর আন্তরিকতায়পূর্ণ। তাঁর কবিতায় পূর্ববঙ্গের প্রাকৃতিক শোভা, বস্ত্তনিষ্ঠতা এবং গভীর পত্নিপ্রেম ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রথমা পত্নী সারদাসুন্দরীর মৃত্যুর প্রায় সাত বছর পর তিনি দ্বিতীয়বার (১৮৯২) দারপরিগ্রহ করেন। কিন্তু কবিতার মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রথমা পত্নীকে অমর করে রেখেছেন।কবি গোবিন্দচন্দ্র তাঁর কবিতায় যে আঞ্চলিক রীতি প্রয়োগ করেছেন তার ফলে বাংলা কবিতায় এক নতুন স্বাদের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।
নওগাঁ।